বঙ্গের
অব্দ, এই অর্থে বঙ্গাব্দ। বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বা বাংলা
বর্ষপঞ্জি হল বঙ্গদেশের একটি ঐতিহ্য মণ্ডিত সৌর
পঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। এই অব্দ শকাব্দের ৫১৫
বছর পরে প্রচলিত হয়। বঙ্গদেশে কবে থেকে
বর্ষ গণনা শুরু হয়েছিল, তার
যথাযথ ইতিহাস জানা যায় না। কেউ কেউ বলে থাকেন, প্রাচীন
বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক
৫৯৩-৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন ৷ সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের
রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন।মূলত বঙ্গাব্দ হলো বঙ্গদেশের বর্ষগণনার একটি ধারাবাহিকতার
একটি ফসল। কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা বঙ্গাব্দ নামের অব্দ
শুরু হয়েছিল, তা
বলা যায় না। বিক্রামাব্দ, লক্ষ্মণাব্দ
ইত্যাদির মতো অত সহজে বলা যায় না অমুকে অমুক সময় বঙ্গাব্দ নামে একটি অব্দ চালু
করেছিলেন।বঙ্গাব্দ-সহ ভারতীয় সকল অব্দের শুরুটা
হয়েছিল মূলত বৈদিক ঋষিদের দ্বারাই। আর্যরা যখন বঙ্গদেশে প্রবেশ করেছিল, তখন
এই অঞ্চলের আদিবাসীরা বর্ষগণনা করতেন কি না তা জানা যায় না। সেকালের বৈদিক ঋষিরা
ছিলেন সর্বভারতীয়। আর্য ঋষিরা জ্যোতির্বিজ্ঞানর চর্চা করতেন জানার আগ্রহে। সে
অধীত জ্ঞান আবার একই সাথে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড প্রতিপালনের জন্য ব্যবহার করতেন। এই
সূত্রে আর্য ঋষিরা, খালি চোখে দেখা যায় এমন দূর আকাশের নক্ষত্রাদি, সূর্য, গ্রহাদি
(খালি চোখে দেখা যায় এমন গ্রহগুলো), চন্দ্র ইত্যাদির গতিপথ এবং
পৃথিবীর ঋতুচক্র ইত্যাদি মিলিয়ে পঞ্জিকার পত্তন ঘটিয়েছিলেন। সূর্যোদয়ের
সঙ্গে সঙ্গে সৌরদিন গণনা শুরু হয়।
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন
হয়। এই সময়টাই এক সৌর বছর। গ্রেগরীয়
সনের মতন
বঙ্গাব্দেও মোট ১২ মাস। এগুলো হল বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন,
কার্তিক, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র। মাসের
নামগুলো গৃহীত হয়েছে ভারতীয় জ্যোতির্বজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণের সূত্রে। প্রাচীন ভারতীয় বাহর্স্পত্য সংবৎ -এ
বাংলা মাসের নামগুলো পাওয়া যায়। ভারতের একটি অন্যতম অব্দ ও বিক্রমাব্দ’ শুরু
হয়েছিল ৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এই অব্দের মাসগুলো বাংলা মাসের নামের মতোই। এরপরে
আমরা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো অব্দ পাই ও শকাব্দ।
এক সময় বাংলাদেশে এই অব্দ অনুসরণ করা হতো। ১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিক্রমাব্দ এবং শকাব্দ বিশেষ
স্থান দখল করে ছিল।
আকাশে রাশিমণ্ডলীতে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের
মাসের হিসাব হয়ে থাকে। যেমন যে সময় সূর্য
মেষ রাশিতে থাকে
সে মাসের নাম বৈশাখ। বাংলা মাসের নামগুলো গৃহীত
হয়েছে ভারতীয় জ্যোতির্বজ্ঞানের ক্রমধারার সূত্রে। ভারতের আর্যদের দ্বারা প্রণীত বেদকে আদিগ্রন্থ বলা
হয়। বেদের আনুষঙ্গিক বিষয়ে নিয়ে ছয় প্রকার শাখা তৈরি হয়েছিল। এই শাখাগুলি বেদাঙ্গ নামে
অভিহিত হয়ে থাকে। এর ভিতরে পঞ্চম শাখা হলো– জ্যোতিষ। জ্যোতিষশাস্ত্র প্রধানত
তিনটি ভাগে বিভক্ত। এই ভাগগুলো হলো– গণিত, হোরা এবং সংহিতা। জ্যোতিষশাস্ত্রের গণিত দুই
ভাগে বিভক্ত। এই ভাগ দুটি হলো– সিদ্ধান্ত ও করণ। ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বরাহমিহির "পঞ্চসিদ্ধান্তিকা" নামক
একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটি পাঁচটি খণ্ডে সমাপ্ত। এই গ্রন্থটিকে
জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হয়।
পঞ্চসিদ্ধান্তিকার পাঁচটি খণ্ডের নাম– এই সিদ্ধান্তগুলো হল– সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত, রোমক
সিদ্ধান্ত ও ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত। প্রাচীন দিন,
মাস, বৎসর গণনার ক্ষেত্রে 'সূর্যসিদ্ধান্ত' একটি
বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল। বরাহমিহিরের
পরে ব্রহ্মগুপ্ত নামক অপর একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী (জন্ম ৫৯৮) একটি সিদ্ধান্ত রচনা
করেছিলেন। এই গ্রন্থটির নাম ব্রহ্মস্ফুট
সিদ্ধান্ত।
ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে সৌর-মাস
নির্ধারিত হয়, সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। সূর্যের
ভিন্ন অবস্থান নির্ণয় করা হয় আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের বিচারে। প্রাচীন কালের
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ
করেছিলেন। এর একটি ভাগকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে
পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছিল
রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হলো– মেষ,
বৃষ,
মিথুন,
কর্কট,
সিংহ,
কন্যা,
তুলা,
বৃশ্চিক,
ধনু,
মকর,
কুম্ভ
ও মীন। আবার অন্যদিক থেকে
ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সমগ্র আকাশকে একটি বৃত্তাকার চক্র হিসাবে কল্পনা করে
২৭টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগগুলোকে নক্ষত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এই
নক্ষত্রগুলো হলো– অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী,
হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া,
শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্বভাদ্রপদা, উত্তরভাদ্রপদা এবং রেবতী। এর ফলে নক্ষত্রের
স্থানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬০/২৭ ডিগ্রি= ১৩ ডিগ্রি ২০ মিনিট=৮০০ মিনিট। সূর্যের
বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য
কোনো না কোন রাশির ভিতরে অবস্থান করে। এই বিচারে সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে সংক্রান্তি বলা হয়। এই বিচারে
একবৎসরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর
সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়। লক্ষ্য করা যায়, সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি
অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের রাশি অতিক্রমের সময় হতে
পারে– ২৯, ৩০, ৩১ বা
৩২ দিন। সেই কারণে একটি বৎসরের ১২ মাসের দিন সংখ্যা সমান হয় না। মাসের নামকরণের
ক্ষেত্রে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মূল তিনটি সূত্রকে অনুসরণ করেছিলেন। সূত্র
তিনটি হলো–
v প্রথম বিবেচনা করা হয়, সূর্য কোন রাশিতে অবস্থান করেছে।
v ওই রাশিতে সূর্য কখন প্রবেশ করেছিল এবং
কবে ?
v ওই রাশিতে অবস্থানকালে পূর্ণিমার সময়
সূর্য কোন নক্ষত্র বরাবর ছিল।
এই
তিনটি সূত্রের উপর ভিত্তি করে মাসের দিন সংখ্যা এবং নাম বিবেচনা করা হয়েছে। ধরা
যাক বৎসরের কোনো এক সময় সূর্য মেষ রাশিতে আছে। যে মুহূর্তে সূর্য মেষ রাশিতে
প্রবেশ করবে, সেই মুহূর্ত থেকে মেষরাশির মাস শুরু হবে। যে মুহূর্তে সূর্য মেশ রাশি অতিক্রম করে, পরবর্তী
বৃষ রাশিতে প্রবেশ করবে, সেই মুহূর্তে মেষ রাশির মাস শেষ হবে যাবে। তৃতীয়
সূত্রানুসারে, মেষরাশির পূর্ণিমার সময় সূর্য বিশাখা নক্ষত্রের উপর অবস্থান
করেছিল, এই কারণে বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে মেষ রাশির মাসটির
নামকরণ করা হয়েছিল– বৈশাখ। এই সূত্রে ১২টি মাসের নামকরণ করা হয়েছিল। বেদাঙ্গ
মতে বর্ষ শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাসে। উল্লেখ্য সংস্কৃত ও অয়ন’ বৎসর।
বৎসরের অগ্র হিসাবে এই মাসের নাম ছিল ‘অগ্রহায়ণ’। মূলত সে সময়ে বৎসর শুরু হতো বৃশ্চিক
রাশিতে, মৃগশিরা
নামক নক্ষত্রের নামানুসারে মাসের নাম মার্গশীর্ষ না হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘অগ্রহায়ণ’। বাংলা মাসের নামগুলো গৃহীত
হয়েছে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্রমধারার সূত্রে। এই নামগুলি মূলত মহাকাশীয় বস্তু
(গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র) থেকে গৃহীত হয়েছে।
দিনের
নাম
|
মহাকাশীয়
বস্তু
|
সোম
|
চন্দ্র
|
মঙ্গল
|
মঙ্গল গ্রহ
|
বুধ
|
বুধ গ্রহ
|
বৃহস্পতি
|
বৃহস্পতি গ্রহ
|
শুক্র
|
শুক্র গ্রহ
|
শনি
|
শনি গ্রহ
|
রবি
|
সূর্য
|
বাংলাদেশ এবং
পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে
এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। বঙ্গাব্দ শুরু হয় পহেলা বৈশাখ বা
বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন